জোয়ারের পানিতে মিশে খাবারের প্যাকেট ও পানির বোতলসহ নানা রকম প্লাস্টিক বর্জ্য বনের মধ্যে প্রবেশ করে গাছপালার শ্বাসমূলে আটকে যায়। এর ফলে গাছপালা মারা যাচ্ছে। বনে থাকা পশু-পাখি প্লাস্টিকের প্যাকেট খেয়ে ফেলায় তারাও মারা যাচ্ছে।
বন বিভাগের উদাসীনতার কারণে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের মধ্যে বাগেরহাটের শরণখোলা ও মংলার করমজল, পশ্চিমের মধ্যে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কলাগাছি এবং খুলনা জেলার কয়রার হাড়বাড়িয়া এলাকায় আসা ভ্রমনকারীরা অনেকটা এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ান।
ঘুরে বেড়ানোর সময় তারা বনের বানর-হরিণকে নিজেদের সাথে আনা বিস্কুট, মুড়ি ও চিপসসহ নানা খাবার ছুড়ে দেন। তাদের দেয়া এসব খাবার খেয়ে সুন্দরবনে থাকা প্রাণীরা অনেকসময় অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বনের কলাকাছি এলাকায় ঘুরতে আসা এক দর্শনার্থী পাইকগাছা গ্রামের হাফিজুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি জনান, ‘বনের বানরদের খাবার না দিলে তারা আমাদের তাড়া করে। ট্রলার থেকে নামতে দেয় না। আর হরিণকে খাবার দিলে তারা আমাদের কাছে চলে আসে, তখন খুব ভালো করে দেখা যায়। হরিণের গায়ে হাতও দেয়া যায়।’
পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়ক মাহফুজুর রহমান বলেন, সুন্দরবন হলো ম্যানগ্রোভ বন। এখানকার গাছের শ্বাসমূলটি সাধারণত ওপরে থাকে। যখন পর্যটকরা বনের মধ্যে প্লাস্টিক, কাগজপত্র ও বিভিন্ন রকমের খাবারের প্যাকেট ফেলেন, তখন সেটা গাছের শ্বাসমূলে গিয়ে আটকে থাকে। বনের বিভিন্ন পশু-পাখি এগুলো খেয়ে ফেলে। তখন তারা মারা যায়।
আবার পর্যটকরা বনে বেড়াতে গিয়ে বানর ও হরিণসহ নানা বন্যপ্রাণীকে বিস্কুট, চিপস, মুড়ি ও বাদামসহ নানারকম বাইরের খাবার খেতে দেন। ফলে এসব প্রাণী বনের খাবার ছেড়ে এসব খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এতে করে প্রাণীদের খাদ্যশৃঙ্খলায় পরিবর্তন আসে। তারা এসব খাবারের লোভে লোকালয়ে চলে আসছে। সেই সঙ্গে বনের পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে বলে জানান তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি কোনো বড় কর্মকর্তা করমজলে এলে তাদের বিনোদন হিসেবে কুমিরদের সামনে জীবিত মুরগি ছুড়ে দেয়া হয়, যা অত্যন্ত অসভ্যতা। বন বিভাগ যদি এ কাজটি করে, তাহলে সাধারণ পর্যটকদের কী দোষ? তাছাড়া পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য কলাগাছি ও হাড়বাড়িয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় হরিণকে আটকে রাখা হচ্ছে। দেয়া হচ্ছে বাজারের নানারকম খাবার। পরে ছেড়ে দিলে তারা আর বনের খাবার খায় না। কিন্তু বাইরের খাবার খেয়ে প্রাণীরা প্রজনন ক্ষমতা হারাচ্ছে। এতে সুন্দরবনের পশুদের বংশবিস্তার হুমকির মুখে পড়ছে।’
পর্যটকদের বিরুদ্ধে বনে বর্জ্য ফেলার অভিযোগ উঠলেও ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান ডেভিড দাবি করেন, ‘ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে বনে যাওয়া পর্যটকরা এ ধরনের কাজ করেন না। আমরা যাদের নিয়ে যাই তাদের এ কাজ করতে দেয়া হয় না। যারা ব্যক্তি উদ্যোগে যায়, তারা এসব কাজ করে থাকে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমার পূর্ব বন বিভাগে প্রাণীদের বাইরের খাবার দেয়ার সুযোগ নেই।’
এসব বিষয়ে পর্যটকদের সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মদিনুল আহসান বলেন, ‘এভাবে প্রাণীদের খাবার দেয়ায় তারা অলস হয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে তারা হিংস্রও হয়ে উঠছে। বানরগুলো পুরোপুরি ডাকাতে পরিণত হয়েছে। পর্যটকদের তাড়া করছে। এসব প্রাণী এখন বনের খাবার খেতে চায় না।’